আমি যে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি সেটা ভেতর থেকে আবদ্ধ হলেও মনে হচ্ছে অসংখ্য স্মৃতিরা নিরন্তর মনের জানালায় এসে ভিড় করছে। বাস্তবতা আর কল্পনার মাঝামাঝি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে অগণিত স্মৃতির মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে আর পানির ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কণাগুলো নীরবে আমাকে অনেক প্রশ্ন করে যাচ্ছে কিন্তু নির্বাক হয়ে শুধু তাদের অবলোকন করে যাচ্ছি। বাস্তবে পুরো পরিস্থিতি দুই হাতে সামাল দিলেও ঘটনার আকস্মিকতায় ভেতর থেকে নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছি।
জানালার পাশ ঘেঁষে আমার বসার চেয়ার আর তার পাশেই ছোট্ট একটা বিছানা। মাঝে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে পাশেই রোগীর শয্যা। তাতে যিনি শুয়ে আছেন তিনি আমার জন্মাবধি সুখদুঃখাদির ধারণকারিণী মা। গত তিনদিন যাবৎ এখানে শয্যাশায়ী রয়েছেন। মায়ের স্ট্রোক হয়েছে। ডাক্তারী ভাষ্যমতে মাইল্ড, মডারেট আর সিভিয়ার – এ তিন প্রকারের হয়। ডাক্তার বলেছিলেন, মায়েরটা মধ্যম পর্যায়ের। চোখের সামনেই কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া এ নিঃশব্দ আততায়ী কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই। শরীরের বাঁ পাশের কাজ করার সক্ষমতা হারিয়েছেন মা। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়েছে, বাইরে দরজায় নক পড়লো আর স্টাফ এসে খাবার রেখে গেল।
জিজ্ঞেস করলাম: “ভাত খাবে? খাইয়ে দিই?”
মা: তুই দুপুরে কী খেয়েছিস?
আমি: ভাত, ডাল, সবজি
মা: মাছ/মাংস ছিল না
আ: ছিল তো কিন্তু ওরা বেশি মশলা দেয়।

শোয়ার বেডটা মাঝখান থেকে তুলে সোজা করে দিলাম যাতে হেলান দিয়ে বসতে পারেন। খাবারের ট্রে তে ভাত, ডাল, সবজি দু’টুকরো মাছ, দু’টুকরো কুসুম ছাড়া ডিমের সাদা অংশ। চামচে তুলে খাইয়ে দিচ্ছি। বাঁ ঠোঁট চামচ দিয়ে কিছুটা তুলে খাইয়ে দিতে হচ্ছে বারবার, না হলে খাবার লেগে থাকছে। তবে খেতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। সাথে সাথেই শুয়ে পড়া উচিত না। অল্পক্ষণের মধ্যেই বাপি এসে পৌঁছলেন, কিছুটা ভিজে গেছেন বৃষ্টিতে। ডাক্তার কখন এসেছিলেন, খাবার, ওষুধ, নার্স – সবকিছুর খোঁজ নিলেন। বাপির খাবারও চলে এসেছিল। হাত- মুখ ধুয়ে জামা-কাপড় পালটে খাওয়া শেষ করে মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে রোগীর পাশের ছোট্ট বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মায়ের ঘুম আসছে না। তবুও বললাম কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নাও।
আমি জানালার পাশের চেয়ারে বসলাম। বৃষ্টি কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। যে স্মৃতিরা হৃদয়ের মণিকোঠায় ভিড় করছিল সেটার ঝাঁপি খুলে দিলাম।
মনে পড়ে, ছোটবেলায় যখন বাড়ি যেতাম তখন খুব দৌড়াদৌড়ি করতাম। সারাদিন খেলতাম। তারপর রাতে শুয়ে পড়লে মা না আসা পর্যন্ত কোনভাবেই ঘুম পেত না, যত রাতই হোক। মা বড় বৌ হওয়ায় সব কাজ সেরে আসতে রাত হয়ে যেত। আশ্চর্যের বিষয় – যখন তিনি পাশে এসে শুয়ে জড়িয়ে নিতেন তখন অদ্ভুত একটা গন্ধ পেতাম, আধ খোলা চোখে দেখতাম। যা ঘটুক, যত ক্লান্তিই আসুক না কেন এর আগ পর্যন্ত ঘুম পেত না। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এই আশ্চর্যজনক গন্ধ শুধু বাড়িতে গেলেই পেতাম। ওটা হয়তো গ্রামের সরল শ্যামলা মেঠো প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার ঘ্রাণ। দুই মা – একদিকে গর্ভধারিণী মা, অন্যদিকে চিরসবুজ শান্ত সুনিবিড় প্রকৃতি মাতা। দু’মাকেই খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হতো তখন। শৈশবের সে দিনগুলো যেন চিরহরিৎ রঙে রাঙা।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। মা বাপীকে ডেকে দিতে বললো। বাপি উঠে আমাকে দেখে বললেন, “তুমি ঘুমাও নি?”
আমি – না, এই তো, ঘুম আসলো না।
মা – গতকাল রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?
আ – হ্যাঁ, তোমার হয়েছিল কি না তা ই বলো?
মা – আমার আর কি? কিছুক্ষণ গরম, কিছুক্ষণ ঠান্ডা লাগে!!
আ – এসি চলছে তো! তাতেও?
মা- আমার সবসময়ই অমন লাগে।
বাপি চা, স্যান্ডুইচ অর্ডার দিলো। মায়ের স্যুপও চলে এসেছে। মাকে খাইয়ে দিয়ে আমরাও খেয়ে নিলাম। মুখে অরুচি হচ্ছে একই খাবার খেতে খেতে। তাই মাঝে মাঝে কয়েকটা নোনতা বিস্কুট খাইয়ে দিলাম। মা-বাপি কথা বলছিলেন। রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেলাম। রোগীদের কক্ষের সারি পেরিয়ে সোজা হেঁটে বাইরে এলে প্রশস্ত বারান্দা। নিচে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিক্রি হচ্ছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছে।
আগেই প্রথম হওয়ার সুবাদে শিক্ষক শিক্ষিকারা সবাই আদর করতেন। পরীক্ষা আগেই শেষ হয়ে যেত। যখন খাতা রিভাইজ দিতাম তখন নানাবিধ প্রশ্ন করতেন।
সাধারণ প্রশ্ন ছিল – “সকালে কী খেয়ে এসেছো?”
বলতাম – আলুভাজি আর ভাত।
পরবর্তীতে পরীক্ষার সময় আবার একই প্রশ্ন কিন্তু এবার ভিন্ন কেউ। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই উনারাই বলতেন –
“আলুভাজি আর ভাত! তাই না?”
পরে মাকে বাসায় ঘটনাটা বলাতে মা বললেন, “শোন, একদিন আলু ভাজি বলবি, পরের দিন পটল, কাকরল ভাজি, আর একদিন বেগুন ভাজা বা ফুলকপি ভাজি বলবি! তাহলেই হলো, বুঝলি?”
আমি সেটা মেনে চললাম। তারপর দেখলাম উনারাও বুঝে গেছেন। যা-ই খেয়ে আসি না কেন প্রতিদিন একই উত্তর আর শুনবেন না।
বারান্দা থেকে আবার রুমে চলে এলাম। মায়ের ওষুধের সময় হয়েছে। নার্সকে ডাকার কলিং বেলে চেপে দিলাম। মায়ের রাতের খাবারও চলে এসেছে।
নার্স সময়মতো ব্লাড সুগার মিটার, ইনসুলিন নিয়ে হাজির। উনার কাজ শেষ হওয়ার পরে খাইয়ে দিচ্ছি – রুটি, সবজি, পেঁপে আর ডাল। বাপিও অর্ডার দিয়ে দিয়েছেন আমাদের দু’জনের জন্য। টিভি দেখতে বড় ভালোবাসেন মা, মনোযোগ দিয়ে ছোটদের মতো দেখছেন।
এ চেহারায় মাকে বড়ো অদ্ভুতুড়ে দেখাচ্ছে – হাতে শাঁখা নেই, সোনার বালা নেই, কানে দুল নেই, কপালে টিপ, সিঁথিতে সিন্দুর নেই। তবে পায়ে আলতা ছিল আর সেটার কিছুটা লালচে আভা এখনও রয়ে গেছে। এসবের বদলে হাতে একটা পাতলা কাগজের বেল্ট যেটা সব রোগীদের হাতেই লাগানো থাকে।
খাবারের আগের ওষুধ আমি খাইয়ে দিয়েছিলাম। পরেরটা নিয়ে সেবিকা কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন। আমি আর বাপিও খেয়ে নিলাম। স্বভাবতই হাঁটতে বেরুলাম। এবার উপরের ক্যাফেতে চলে গেলাম। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, খোলা আকাশ। এখানে আসার পর একটা ঘটনা মনে পড়েছে।
হাসপাতালে আসার দ্বিতীয় দিনে মায়ের সাথে আমার দেখা। কারণ প্রথমদিনে মাকে হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে রাখা হয়েছিল। পরেরদিন যখন রুমে দেওয়া হচ্ছে তখন আমাকে দেখেই হু হু করে কাঁদতে লাগলেন। হাতে চুমু দিতে লাগলেন। মনে হলো আমি উনার ছোট্ট বাবুটি! দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে জল পড়লেও শুধু মুখের ডানদিকটাই নাড়াতে পারছেন। এভাবে কাঁদতে দেখে ওয়ার্ডবয়, নার্সরা মাকে সান্ত¡না দিতে লাগলেন। মা একাকিত্বকে খুব ভয় পান। খুব জোর দিয়ে আমার হাত চেপে ধরে আছেন – জীবনে প্রমবারের মতো মনে হলো মা আমার ছোট্ট মেয়ে হয়ে গেছেন! যার এই দুটি হাত ধরে আমার পথ চলা শুরু, যার কোলে চড়েছি, মাথা রেখে ঘুমিয়েছি কত অসংখ্যবার তার ঠিক নেই। আজ সময়ের আবর্তনে নিজেই বিপরীত ভূমিকায়।
মেঘেরা দ্রুত সরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ নক্ষত্ররাজিদের দেখছি, পরক্ষণেই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সেভাবেই অতিদ্রুত বহমান সময়ের স্রোতও। মাঝে মাঝে মনে হয় কীসের পেছনে এত ছুটছি? কীসের মোহে? কী হবে এসব দিয়ে? এসব করতে গিয়ে যার খুব কাছে থাকার কথা তার কাছে থেকেই অনেক দূরে সরে যাচ্ছি! আজ অসময়ে অকস্মাৎ এসে হাজির হওয়া অসুখ আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়েছি।
রুমে গিয়ে দেখি দুজনেই শুয়ে পড়েছেন। মায়ের ঘুম আসেনি। আমাকে দেখে বললেন, “কি রে, ঘুম আসছে না?”
আমি – না, আসলেই ঘুমিয়ে পড়ব।
মায়ের পাশে দেওয়া ছোট্ট বিছানায় শুয়েছি আর বাইরে তাকিয়ে ভাবছি, স্মৃতির ঝাঁপিটা অনেক ঋদ্ধ। অত তাড়াতাড়ি ফুরোনোর নয়। ঘটনাপ্রবাহের স্রোত ভাসিয়ে আমাকে আগের সেই দিনগুলোয় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ক্ষণকালের জন্য। আজকের মতো ঝাঁপিটা ওভাবেই খোলা রেখে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলাম। হয়তো নিদ্রাচ্ছন্ন হলেও ওরা আমার পিছু নেবে।
হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছি সপ্তাহ খানেক হলো। এখন মা হাঁটতে পারছেন, বইও পড়ছেন, উপাস, পূজা-অর্চনা করার পাশাপাশি বুয়াকে রান্নার নির্দেশনাবলিও দিচ্ছেন। সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘক্ষণ স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সক্ষমতা হারিয়েছেন আর স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলাফেরার শক্তিও কম। তবে ডাক্তার বলেছেন, আগামী বছরের মধ্যেই মা পুরোপুরি চলনশক্তি ফিরে পাবেন।
আমার স্মৃতির ঝাঁপির ঋদ্ধতার পেছনে মায়ের মায়া জড়ানো ঘটনাবলির সমষ্টি পুঞ্জিভূত হয়েছে বলেই সেগুলো সবসময়ই হৃদয়ের মণিকোঠায় চির ভাস্কর। আরও অনেক কথাই বলার ছিল যা অকথ্য রয়ে গেল। যাক! কিছু কথা বারবার ফিরে আসে অতীত থেকে। আর স্মৃতিরা সব কালেই আমৃত্যু সঙ্গী হয়ে রয়।
তথ্যসূত্র: গল্পেসল্পে কিছুক্ষণ। লেখক: অতনু দাশ গুপ্ত। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২২।