
ছোটবেলার কথা বেশ মনে পড়ে যাচ্ছে। শেষ ক্লাসে ছুটির ঘন্টা বেজে উঠতেই মনও আনন্দে নেচে উঠলো। ছুটি অবশ্য সবকিছু মিলিয়ে পনের দিনের আর এর পরের ঠিক সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই পরীক্ষা! কিছুটা যে পরীক্ষা ভীতি কাজ করছে না তা নয় তবে মন বেশ চনমনে হয়ে অপেক্ষায় আছে কখন মাসির বাড়ির বাসে উঠব? ছোট্ট শহর চন্দ্রঘোনা থেকে চট্টগ্রামে যেতে দুই থেকে আড়াই ঘন্টার মতো লেগে যায়। তারপর বহদ্দারহাট মেইন বাস টার্মিনাল থেকে ট্যাক্সিতে সোজা উত্তর কাট্টলির বিখ্যাত মজুমদার বাড়ি – ছোট মাসির ঠিকানা।
মাসির দোতলা বাড়ির নিচের তলায় ঠাকুর ঘর, ওই ঘরেই মাসির ছেলের পড়ার ঘর,একটু সামনে এগিয়েই টিভি ঘর আর আমাদের আড্ডার ঘরও বলা যায়। অপর পাশে ওদের বেডরুম আর রান্নাঘর। উপরে একটা ঘর রয়েছে যেখানে অনায়াসেই বিছানা পেতে যে কেউ শুতে পারবে। রাতে কারেন্ট চলে গেলে আমরা তলপিতলপা গুটিয়ে উপরের ঘরেই চলে যেতাম। আহা! সুশীতল বাতাসের সাথে শীতল পাটিতে শরীর এলিয়ে দিলেই হলো। ব্যস! কখন অঘোর ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছি ইয়ত্তা নেই।
আসি মূল পূজোবাড়ির কথায় – এটাকে দূর্গা বাড়িও বলা যায়। মজুমদার বাড়ির দূর্গা বাড়ির ইতিহাস পুরনো। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এনাদের পূর্বপুরুষেরা দেবীর ঘট এখানে প্রতিষ্ঠা করেন। এদের ঠাকুর ঘরে সারা বছর মায়ের প্রতিমা থাকে। কাজেই যখন যাওয়া হতো, মায়ের দর্শন করা যেতো। প্রতি বছর প্রতিমা বিসর্জ্জন হতো আগের বছরেরটা। নতুন মায়ের প্রতিমা ঠাকুর ঘরে রয়ে যাবে সারা বছর। এটাই এ বাড়ির পূজোর নিয়মের বিশেষত্ব। একচালা ঠাকুরের ঘর আর সাদা পূজো হয় এখানে।
পূজোর চারদিন ভিন্ন ভিন্ন পদের নিরামিষ রান্না হবে আর দশমীর দিন আমিষ ভোজন। সকালে ফল ভোগের থালা সাজানোর রয়েছে আলাদা নিয়ম। শুধুমাত্র বাড়ির লোকেরাই তা করে থাকে। নিরামিষ ভোজনের মধ্যে প্রথমদিন অর্থাৎ সপ্তমীর দিন ডাল, নিরামিষ সবজি, আর কয়েক রকমের ভাজা – বেগুন, আলু, মিষ্টি কুমড়ো, অষ্টমীর দিনে সবজি খিচুড়ি আর ভাজি, নবম দিনে হতো সবজি ঘন্ট আর দশমীর দিন আমিষের আয়োজন হতো- মাছ, ডিম, মুরগী, চিংড়ি মাছের ঝোল। একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি প্রায় – মিষ্টান্নের আয়োজন থাকতো প্রতিদিনই – কোনদিন পায়েস, বা টক, আবার কোনদিন মিষ্টি দই, অথবা অম্বল।
দূগ্গা ঠাকুরের বাড়িতে খেতে বসে মনে পড়ে যায় তুলসীধাম আশ্রমের ভোগ প্রসাদের স্বাদের যেমন কোন সংজ্ঞায়ন হয় না তেমন এ বাড়িরও স্বাদ অমৃততুল্য!
দূর্গা পূজায় অবিচ্ছেদ্য অংশ অখণ্ড প্রদীপ প্রজ্বলন আর সেটার তদারকির ভার কেউ না কেউ পালা বদল করে করতে হয়। অখণ্ড প্রদীপের দায়িত্ব একেক দিন একেকজনের ভাগে পড়ে। আরেকটা বিশেষ ব্যপার হচ্ছে – মঙ্গল প্রদীপ দশমীর দিন মূল পূজোর দালান ঘর থেকে ওনাদের আদিঘর যেখানে বাদবাকি সরঞ্জাম থাকে, সেখানে সরিয়ে নেওয়া হতো এবং খুবই সাবধানের সাথে। যদি কোন কারণে বাতি নিভে যায় তাহলে সেটাকে অমঙ্গলকর বলে ধরে নেওয়া হয়। তাই যার দায়িত্ব পড়তো, তাকে সবদিক থেকে চোখে চোখে রাখতো সবাই। রাত জেগে ওটা পাহারা দিতে দিতে চণ্ডীপাঠ পড়া, তাও একবারে ব্রাহ্ম মূহুর্ত পর্যন্ত! মন জুড়িয়ে যাবে যে কারও।
পাড়া বেড়ানোর কথা বলতে গেলে মাসির বাড়ির পাশাপাশি রয়েছে কালীবাড়ি। ওখানেও পূজো হচ্ছে! প্রতিমা দর্শন ওখান থেকেই শুরু হবে। তারপর পাড়াময় ঘুরে বেড়ানো। মেলায় গিয়ে মিষ্টি গজা, বাতাসা, নকুলদানা, কদমা, হাওয়াই মিঠাই, মাখানো ঝাল মুড়ি আর ফুসকা চটপটি তো আছেই!! পাড়া ঘুরতেই খাবার ভাগাভাগি করে খেয়ে নিতাম আমরা। শরতের আকাশে সূর্যের তেজ থাকে বেশ। তাই বেশ কিছুক্ষণ ঘোরার পর এক জায়গায় লোকনাথ বাবার আশ্রম দেখতে পেয়ে দলবল সবাই ঢুকে পড়লাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। তাই পুরোহিত মশাইকে দেখতে পেলাম না। বাইরে মন্দির প্রাঙ্গণে কিছুক্ষণ বসে রবি কিরণের তেজ কমতি দেখে আবার যাত্রা শুরু হলো। থিম কেন্দ্রীক পূজোর বেশ চলন থাকলেও এখানে দূর গায়ে সাবেকীআনার ছাপ দেখে বড়ো ভালো লাগছে। মনে পড়ে যাচ্ছে যখন আরও ছোট ছিলাম তখন বাড়ির পাড়া বেড়ানো পূজোয় প্রতিমা ঠাকুর দেখতাম আর গুণে যেতাম কয়টা প্রতিমা দেখলাম। একবার মনে পড়ে গোনা শেষ হয়েছিল চৌদ্দ তে এসে! বিকেলে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত চলতো ওই অভিযান! একটা ট্যাক্সি রিজার্ভ করে… দে ছুট!!
এখানকার পাড়া বেড়ানোয় অবশ্য সেটার প্রয়োজন হচ্ছে না, পূজো প্যান্ডালগুলো পাশাপাশি।
পাড়ার পূজো দেখা শেষ করে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। সন্ধ্যায় মাসির বাড়ির দূগ্গা ঠাকুরের সামনে বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই সন্ধ্যা আরতী করবে। চন্ডী পাঠে শুরু হবে আরাধনা আর একে একে গান গেয়ে শেষ হবে। একেক দিন একেক আয়োজন হবে। নাচের আয়োজনও করবে বাড়ির মেয়েরা।
মন্দির প্রাঙ্গণে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয় যখন সন্ধ্যাপ্রদীপ প্রজ্বলন করা হয় আর সমস্বরে সবাই গেয়ে ওঠে, “মঙ্গলদ্বীপ জ্বেলে…. অন্ধকারের দুঃখ আলোয় ভরো, প্রভু।”
পূজোর প্রতিটি দিন স্বপ্নের মতো কেটে যেতো, বলা বাহুল্য বেশ তাড়াতাড়িই। দশমীর দিন হরেক রঙের বাহারের দেখা মেলে, সবাই মনে হয় দোলখেলায় মেতে উঠেছে। আমি বাড়ির ছাদে চলে যেতাম আর নিচে সবার রঙের খেলার পাগলামি দেখতাম! যখন দর্পন বিসর্জন হতো শাড়ির আঁচলে মুখ গুজে কান্নার রোল পড়ে যেত। দেখে মনে হতো, মেয়ের বিয়ে শেষে তাকে বিদায় জানানো হচ্ছে। বাড়ির চারিদিকের পরিবেশ কিছুক্ষণের জন্য কেমন যেন থমথমে হয়ে যেত।
দশমীর দিন কান্না পাওয়াটা আমার কাছে চিরকালই আর্শীবাদ তুল্য! মায়ের সাথে এক মনে কথা বলতাম! (এখনও যখনই ইচ্ছে হয়, বলি!) একটা কথাই মাকে বলতাম, আজও বলি, “আগামী বছর আবার দেখা হবে তো, মা? সবই তো তোমার হাতে, মা। এ সুবিশাল জগৎ সংসার তোমার হাতে গড়া, তোমার মায়ায় লালিত- পালিত। যাকে ইচ্ছে রাখবে আর যখন ইচ্ছে হবে ও পারের ডাক আসবে! যেভাবেই রেখো, সকলকে ভালো রেখো,মা!! হই না তোমার অধম সন্তান, তবুও তোমার সন্তান। এক চিলতে শান্তি তোমার কোলেই আছে!! ”
তথ্যসূত্র: গল্পেসল্পে কিছুক্ষণ। লেখক: অতনু দাশ গুপ্ত। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২২।