২৬শে মার্চ, ১৯৭১ – পঁচিশের কালরাত্রির অন্তে নবচেতনার অন্য এক দিগন্ত উন্মোচনের প্রচেষ্টায় সমগ্র বাঙ্গালী জাতি যখন একীভূত হচ্ছিল, তখনও পাকিস্তানী হায়েনারা অগণিত হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। নরপশুদের বিষাক্ত থাবায় শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে অঙ্গার হচ্ছিল।
চট্টগ্রামের অদূরে সুলতানপুর গ্রামে মনীন্দ্র বাবুর সংসার – স্ত্রী মালবিকা, তিন পুত্র – দুলাল, বাদল, বাবুল। সারাদিন মাঠের কাজ সেরে বিকেলে হাঠহাজারি বাজারে গিয়ে দেখেন সবাই উদ্ভান্ত্রের মত দৌড়াচ্ছে। আশেপাশের অনেক জায়গা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক মিলিটারিরা এগিয়ে আসছে হাটহাজারির দিকে। ও পাশের গ্রামের মানুষজন সবাই পালিয়ে এদিকে চলে আসছে। নির্বিচারে চলছে লুটপাট, হত্যা ,ধর্ষণ।
হাট থেকে তড়িঘড়ি ছুটে এসে মনীন্দ্র স্ত্রী মালবিকাকে যা- ই পারা যায় সব গুটিয়ে নিতে বললেন। গাঁ ছেড়ে যাত্রা করতে হবে নিরুদ্দেশের পথে নচেৎ মৃত্যুদ্বার উন্মুক্ত।
মালবিকা যা পারছেন নিয়ে নিচ্ছেন। দুটি তোরঙ্গ সম্বল করে কাপড় – চোপড়, থালা -বাসন, পূজোর কোষা- কুষি, ঘটি – একান্ত প্রয়োজনীয় আরও তৈজসপত্র নিতে শুরু করলেন। বয়োজ্যেষ্ঠ দুলালকে বললেন নিজের আর ভাইদের কাপড় পুটলি করে নিতে। আলাদা দুটি পুটলিতে অল্প সোনা-দানা ভাগ করে নিলেন মনীন্দ্র, মালবিকা আর দুলালকেও অল্প কিছু সোনা রুমালে বেঁধে দিলেন এটা ভেবে যদি পথে সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে এলেন মনীন্দ্র। আঙ্গিনায় ফেলে রাখা লাঙ্গল – এতদিন এটিই ছিল তার সারাদিনের সঙ্গী। মূল ভিটা থেকে সরিয়ে একপাশে রেখে বড়ই, নারিকেল গাছের ডাল আর খড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। পরক্ষনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, আর কি ? আজ রাতেই হয়তো সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। মাটির ভিটেটি দেখে খানিকটা অশ্রুমোচন করলেন। পূর্বপুরুষের ঘামে – শ্রমে গড়া এই বাড়ি না জানি কত স্মৃতির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবা স্বর্গীয় বরদাচরণ পুরুষানুক্রমে এই ভিটায় ছিলেন। আজন্ম শৈশবস্মৃতি বিজড়িত এ বাড়ি আজ চিরতরে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এটা ভাবতেই বুকের ভেতর হুহু করে উঠছে।
মাতৃভূমির সীমানা অতিক্রমণের প্রত্যাশায় বেরিয়ে পড়লো সবাই। দূরত্ব কতদূর ? গন্তব্যস্থল কোথায় ? – কেউই জানে না, শুধু এটাই জ্ঞাত নিরন্তর পথ চলতে হবে। সামনে মনীন্দ্র, মাথায় ট্রাঙ্ক, পেছনে ছোট্ট বাবুল, বাদল, স্ত্রী মালবিকা, শেষে অগ্রজ দুলাল, – সবার হাতেই রয়েছে পুটলি। যাত্রাপথে অগণিত মানুষের হাহাকারে আশেপাশের পরিবেশ কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠছে। যে যেভাবে পারছে সীমানা পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাবার প্রচেষ্টায় আছে। কারও কোলে বাচ্চা, কোন ম্যা ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে চলছেন, আবার কোন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের কোলে চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধা মাতা, মা – বাবার উভয়ের কোলেই দুদ্ধপোষ্য শিশু। পথিমধ্যে অতিশয় ক্ষুধার্ত হয়ে রাস্তার একপাশে বসে পড়েছেন। কেউ কেউ এক মুঠো চিড়া বা পানি দিচ্ছেন আর কেউ চলার শক্তি হারিয়েছেন তাই বসে পড়েছেন। এক মা বাচ্চা হারিয়ে অঝোরে কাঁদছেন, কারও স্বজন নিখোঁজ হয়েছে ভিড়ে। খুঁজে পাওয়ার আশায় অল্পক্ষণ অপেক্ষারত থাকছেন আবার হাঁটছেন। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছেন তিক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

সুলতানপুর থেকে রাতে যাত্রা শুরু করে মধ্যরাতে পরিবারসহ আরও অসংখ্য পরিবার এসে পৌঁছলো নাজিরহাট হয়ে প্রথমে বিবির হাটের বেশ ভেতরের এক পাড়ায়। যে যা-ই পেরেছে শাড়ি, লুঙ্গি, চাদর কিংবা কাঁথা – এসব বিছিয়ে ওখানেই অবস্থান নিল শরণার্থীরা। প্রভাত সমাগত; ক্লান্তি নিয়ে নিদ্রাচ্ছন্ন হলো সবাই। দুইদিন এখানে কাটানোর পর তৃতীয় দিনে আলবদর বাহিনীর আট – দশজন যুবক এসে হাজির। এত মানুষের সমাগমের খবর পেয়েই আজন্মা নরাধমরা হাজির হয়েছে। হুমকি দিল, যদি সবাই এখানে অবস্থান করে তবে পুরো পাড়াসহ সমস্ত পরিবারের যা আছে লুটে নেওয়া হবে। কয়েকদিন এখানে কাটাতে পারলে মন্দ হত না। অগত্যা চলে যেতে হবে। ওখানকার এক বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক সবাইকে রামগড় হয়ে ত্রিপুরার দিকে যাত্রা করতে হবে। যেখানে সাবরুমের পূর্ব হরিনায় শরণার্থী শিবির স্থাপিত হয়েছে। তিনি সবাইকে পাহাড়ি অঞ্চলের গহিন বন দিয়ে চলার পরামর্শ দিলেন। যাত্রা শুরু হলো স্বদেশত্যাগী অগণিত ত্রিপুরাগামি বিবর্ণ পথচারীদের। ছোট্ট বাদল, বাবুল ক্ষুধার্ত, কাঁদছে। মালবিকা বুঝিয়ে বলেন, কিছুদুর গিয়েই খেতে পারবে।, এখানে খাবার শেষ। ওরাও সরলতার সাথে মেনে নেয়। যেতে যেতে দুলালের কোলে বাদল আর মালবিকার কোলে বাবুল ঘুমিয়ে পড়েছে। ওইদিন ফটিকছড়ি পাড় হতেই রাত হয়ে এল। পথিমধ্যে বিজন বনে রাত কাটানোর জন্য বিশ্রামরত হল সবাই।
পরবর্তী গন্তব্য মানিকছড়ি। ভোরের আলো ফুটতেই পুনরায় যাত্রা শুরু। পুরো একদিন দুর্গম পাহাড়ি পথে হাঁটার পর এক পাহাড়ি বসতিতে গিয়ে পৌঁছল সবাই। নিতান্তই ক্লান্ত-শ্রান্ত, ক্ষুধার্ত, কৃশকায় এত অধিকসংখ্যক মানুষের আগমন কিছুটা হলেও অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে আদিবাসীদের। তবুও সবাই জানে সংকটকালে সহায়তাই মুক্তির একমাত্র পথ। গত কয়েকদিনের অবিশ্রান্ত যাত্রায় শীর্ণতা জর্জরিত তিন ছেলের দিকে তাকাতেই কষ্ট হচ্ছে মনীন্দ্র, মালবিকার। এক পাহাড়ি পরিবার থেকে কয়েক মুঠো চাল আর অল্প নুন এনে ওটাই ফুটিয়ে ভাগাভাগি করে দেন স্বামী, পুত্রদের। মালবিকা নিজে খেয়ে নিলেন ভাতের ফেন। একটা গাছের নিচে চাদর পেতে দুই ছেলেকে নিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। মনীন্দ্র আর দুলাল গাছের দুপাশে হেলান দিয়ে পড়ে রইলেন। ভোরের আলো ফুটতেই আশেপাশের বাড়িগুলো দেখে মনীন্দ্রের নিজ বাড়ির কথা পড়ছে যা এখন হয়তো ভগ্ন, ভস্মীভূত। ক্লেশিত অবস্থায় এখানে ক’দিন অন্ন সংস্থান হল।
এখান থেকে যেতে হবে রামগড়। তারপর ফেনি নদী পেরিয়ে ত্রিপুরা। ওখানেই দক্ষিণ ত্রিপুরাস্থ সাবরুম। এতদিনে কত ক্রোশ পথ অতিক্রান্ত হয়েছে তা অগণ্য, সামনে আরও কত বন্ধুর পথ রয়েছে সেটা বিধাতাই জানেন। রামগড়ের জনহীন এক বনে অভুক্ত রাত কাটল সবার। পরদিন দুপুরে রাস্তা চলা শুরু করে রামগড়ের ফেনী নদী পার হতে গিয়ে সবাই থেমে থেমে হাঁটছে। কর্দমাক্ত রাস্তা মানুষের পদচারনায় ক্রমশ পিচ্ছিল থেকে পিচ্ছিলতর হচ্ছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। সন্ধ্যে হয়ে এল। মনীন্দ্রের হাতে হারিকেন, ছোট্ট বাবুল, বাদল নানারকম প্রশ্ন করেই চলেছে মাকে। তিনি কিছুর উত্তর দিচ্ছেন আর হাঁটতে বলছেন। ভালভাবেই জানেন ছোট্ট ছোট্ট দুটি পা কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বে। অগণিত মানুষের জন্য পারাপারের নৌকা নগণ্যমাত্র। থেমে নেই কারও যাত্রা; হয়তো মধ্যরাত অতিক্রান্ত হয়েছে। আবছা অরুণের আভায় রাঙ্গা আকাশ আর সেই সাথে ফেনী নদী পেরিয়ে মনীন্দ্রের পরিবারসহ অগণিত পরিবার এসে পৌঁছলো সাবরুম। মনীন্দ্রের কাঁধে ঘুমন্ত বাদল, হাতে ট্রাঙ্ক, মালবিকার কোলে ছোট্ট বাবুল, দুলালের মাথায় আরেকটি তোরঙ্গসহ পুটলি। এখানে কোনভাবে আজকের রাত কাটিয়ে কাল আবার যাত্রা শুরু হবে হরিণা র পথে। বহুদূর পথ অতিক্রম করে আসা সবাই অতিশয় ক্লান্ত।
আপদকালীন আশ্রয়স্থল সাবরুমের পূর্ব হরিনার শরণার্থী শিবির। আপাতত সেখানকার কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হয়ে থাকতে হবে সবাইকে। কতদিন তা কেউই জানে না। এই অনিশ্চিত নিরন্তর পথচলা মনীন্দ্রের বিশ্বাসে বিন্দুমাত্র ফাটল ধরাতে পারেনি। তিনি স্বপ্ন দেখেন নতুন দিনের ভাস্করের কিরণে দূর হবে সব বাঁধা, অর্জিত হবে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
পুনরায় প্রারম্ভ হবে পথচলা তবে এবার মুক্ত স্বদেশের পথে।
তথ্যসূত্র: গল্পেসল্পে কিছুক্ষণ। লেখক: অতনু দাশ গুপ্ত। ঢাকা, সাফল্য প্রকাশনী, ২০২২।